পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট খুনিরা শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করতে পেরেছিলো, তবে খুন করতে পারেনি আপামর জনতার ‘শ্যাখ সাহেব-কে, বাঙালির ‘বঙ্গবন্ধু’-কে। যে মানুষটা তাঁর স্বদেশবাসীকে বলতেন ‘আমার মানুষ’ (“কীসের রাউন্ড টেবিল, কার সাথে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সাথে বসবো?” অথবা “আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়…”; ৭ মার্চের ভাষণ)। যিনি বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই”, তাঁকে খুন করা যায় না।

স্বাধীন বাংলার স্বপ্নকে বঙ্গবন্ধু সব বাঙালির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।

যিনি নেতৃত্বগুণে অবিসংবাদিতভাবে উত্তুঙ্গ অদ্রিশৃঙ্গে আরোহণ করেছিলেন, যিনি নায়ক হয়েও ছিলেন সদা জনমুখী; যিনি প্রতিটা বাঙালির ব্যক্তিগত আপনজন, তাঁকে খুন করা যায় না। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরিক্রমায় একাত্তরে তিনি যখন সারা পৃথিবীর ‘শেখ সাহেব’ হয়ে, আমাদের স্বপ্ন ও সোনালি ভবিষ্যতের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন, সেই প্রতিমূর্তিকে মাত্র চার বছরের ব্যবধানে খুন করে ফেলতে পারে, এমন ভয়াল বুলেট, এমন নৃশংস ঘাতক পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি, হওয়া অসম্ভব। ঘাতকেরা যেটা পেরেছে তা হলো একজন ব্যক্তি শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে মাত্র; ব্যক্তিকে হত্যা করলেও ব্যক্তিত্ব রয়ে যায়, থেকে যায় কীর্তি।

ব্যক্তিকে হত্যা করা যায় বটে; কিন্তু ব্যক্তি যখন সকলের ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার সমষ্টিতে একটা রূপক, একটা প্রতীক, একটা আদর্শ এবং শেষমেষ ‘বঙ্গবন্ধুতে’ পরিণত হন, তখন সেই প্রতীক বা প্রতিমূর্তিকে- যার নাম দিয়েছি বঙ্গবন্ধু- তাঁকে ঘাতকেরা খুন করতে পারে না। কিন্তু ঘাতকের সেই অসম্পূর্ণ দুরূহ কাজটা গত প্রায় চার দশক ধরে স্বেচ্ছায়, বুঝে বা না বুঝে একটু একটু করে সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল। যে আওয়ামী লীগের কাঁধে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার দায় ছিলো সবচেয়ে বেশি, তারাই বা এই দায়িত্ব কতোটা পালন করতে পেরেছে, তা মূল্যায়ন করেই তাদের ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ করা জরুরি। পৃথিবীর সকল পরাধীন জাতি ১৯৭১ সালের পর থেকে প্রতীক্ষা করেছে, তাদের মধ্যে একজন বঙ্গবন্ধুর জন্ম হোক। সকল পরাধীন জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু আর বাঙালি হলো প্রেরণার উৎসস্থল। মুক্তিকামী জনগনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিব; নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। অথচ আমরা, বঙ্গবন্ধুর বাঙালিরাই, শেখ মুজিবকে হত্যা করলাম পঁচাত্তরে। শুধু মুজিবকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হইনি আমরা, বঙ্গবন্ধুকেও মারতে চেয়েছি। একের পর এক সংবিধান কাটা-ছেঁড়া করে, অধ্যাদেশ জারি করে, সামরিক শাসনের যাঁতাকলে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সমস্ত চেতনাকে পিষ্ট করার আয়োজন চলেছে এ দেশে। এসবের মধ্য দিয়েই আসলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চলেছে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা নিছক কোন বাগাড়ম্বর নয়; সেটা একটা লক্ষ্য, একটা গন্তব্য- তাঁর মানসলোক থেকে যা কোনদিন অপসৃত হয়নি। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তিনি সামর্থ্যকে অতিক্রম করার সাহস দেখিয়েছিলেন।

তিনি স্বাধীন বাংলা, সোনার বাংলার স্বপ্নকে সব বাঙালির স্বপ্নের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন; বাঙালির ইতিহাসে আর কেউ কখনো যেটা পারেনি। স্তরবিন্যস্ত এবং শ্রেণিস্বার্থ দ্বারা বিভাজিত এই সমাজকে, এই সমাজমানসকে তিনি ওই স্বপ্নের দ্বারা একটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করতে পেরেছিলেন। সেই বিন্দুর নাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, সেই বিন্দুর নাম মুক্তির সংগ্রাম। সেটা পেরেছিলেন বলেই দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সোনার বাংলার গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জন। সেটা অর্জিত হওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নতুন করে গড়ে তোলা। সে জন্য অনেক কাজ। এরপর শোষণমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণের পালা। কিন্তু আমরা তাঁকে সময় দিইনি, সহযোগিতা করিনি; নানাবিধ উৎপাত-উপদ্রবে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছি। সুযোগমতো সপরিবারে হত্যা করেছি। যদিও তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখার জন্য একটা দেশ, স্বপ্ন জমা রাখার জন্য স্বাধীন মাতৃভূমি দিয়ে গেছেন, সেই স্বাধীন মাটিতে, স্বাধীন নদীতে, স্বাধীন সবুজ বন-বনানী, প্রান্তরের মুক্ত বাতাসে আমরা তাঁকে শান্তিতে তাঁর লোকেদের সাথে বেশিদিন থাকতে দিইনি। এটা আমাদের শোক শুধু নয়, এটা আমাদের লজ্জা। তার চেয়েও বড় লজ্জা আমরা সেই স্বপ্নগুলোকেই ভুলে যাচ্ছি, আমাদেরকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওইরকম মহৎ কিছু জাতীয় স্বপ্ন না থাকলে জাতি টিকতে পারে না। আমরা পারবো কিনা, সেটাই দেখার অপেক্ষা!